মিজানুর রহমান টিটু
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠা একটি দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। ৩ হাজার বছরের অধিক কাল ধরে লোক বসতির এই দ্বীপে ছিল লবণ শিল্প জাহাজ শিল্প ও বস্ত্র শিল্পে পৃথিবী বিখ্যাত। এই বিখ্যাত জনপদে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষতার প্রমাণ করেছে বারবার। ঐতিহাসিক এই দ্বীপে রাজনীতির অন্যতম সোনালী পালক ছিলেন মাস্টার শাহাজাহান বিএ।
১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করা মাস্টার শাহজাহান ছিলেন আমেরিকান প্রবাসী আলহাজ্ব তাহের ও বিবি মরিয়মের দ্বিতীয় সন্তান।
রহিমা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন সন্দ্বীপ মডেল হাই স্কুলে। ১৯৬৪ সালে সফলতার সাথে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন সদর সাতকানিয়া ডিগ্রী কলেজে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তিনি বিএ পাস করেন।
তৎকালীন বিএ পাশ করা এই ব্যক্তিত্ব, বিলাসী জীবন ত্যাগ করে নিজেকে শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত করেন। এই দ্বীপে শিক্ষার আলো জ্বালাতে তার নিজ উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে বাউরিয়া জিকে একাডেমী স্কুল পূর্ণগঠন করে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অর্ধ যুগ নিজেকে অবৈতনিক পেশায় নিয়োজিত রেখে ১৯৭৫ সালে সন্দ্বীপ টাউনে অবস্থিত মোমেনা সেকান্দার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
প্রায় ১০ বছর জাতি গঠনের এই মহৎ কাজের মাঝে যখনই রাজনীতির ক্লান্তিকাল এসেছে, তিনি হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। কলেজ জীবন থেকেই তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। ১৯৭৭ সালে বাউরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মাষ্টার শাহজাহান। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি একাধারে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সফলতা ও দক্ষতার কথা লোকোমুখে নানান ভাবে প্রচলিত আছে।একাধারে ২৫ বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তিনি ছিলেন সৎ দক্ষ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সামরিক আইন জারি করলে সকল চেয়ারম্যানের দুর্নীতির তদন্ত নামে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এই অভিযানে একমাত্র মাস্টার শাহজাহানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন প্রমাণ মেলেনি। তাঁর এই সততায় মুগ্ধ হয়ে নৌবাহিনী পুরো সন্দ্বীপের সালিশি দায়িত্ব তুলে দেন তার হাতে।
এছাড়াও ১৯৭৯ সালে দেশে আওয়ামী লীগের যখন কোণঠাসা অবস্থা তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মাস্টার শাহাজান। এই সময়ে তিনি একাই সন্দ্বীপে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যান।
১৯৮১ সালে তার ব্যক্তিগত অর্জনে যুক্ত হয় সফলতার অন্যতম পালক। সন্দীপের সেকান্দর মহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ৪০ বছর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতি গঠনের আত্মনিয়োজিত এই শিক্ষক চুপ থাকতে পারেননি। জীবন শঙ্কাকে উপেক্ষা করে নিজেদেরই খামারবাড়িকে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে গড়ে তোলেন এবং যুদ্ধকালীন অবস্থায় পুরো সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে এই খামারবাড়ি। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করা ব্যক্তি মাস্টার শাহজাহান ৭৫ সালে ১৫ আগস্টের কালো রাতের হৃদয়বিদারক ঘটনার পর সারাদেশের আওয়ামী লীগের নাম নিতে গিয়ে মানুষেরা যখন ভয়ে চুপসে যায় তখন তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহি আত্মার মাগফেরাতের লক্ষ্যে
নিজ বাড়িতে এক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন। এই উদ্যোগের কারণে তিনি শাসক শ্রেণীর রষানলে পড়ে যান।
দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল তাকে দলে পাওয়ার জন্য লোভনীয় প্রস্তাব দিতে থাকে।তার মধ্যে ১৯৭৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান “জাগ” দলে যোগদানের প্রস্তাব দিলে মাস্টার শাজাহান তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এই ক্লান্তিকালেও তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতি একনিষ্ঠ অনুগত। আনুগত্যের অগাধ দৃষ্টান্ত হিসেবে ঐতিহাসিক “বাবুল স্টোরের” কথা না বললেই নয়।
৮০ দশকে সন্দ্বীপে আওয়ামী লীগের কোন স্থায়ী পার্টি অফিস না থাকায় কর্মীদের জন্য বাবুল স্টোর হয়ে উঠে হেডকোয়ার্টার। নেতাকর্মীদের এই অস্থায়ী কার্যালয়ে নিয়মিত দলীয় পরিচর্যা করতেন মাস্টার শাহজাহান। তারই নির্দেশনায় বাবুল স্টোর থেকে নেতাকর্মীরা অবিচ্ছিন্নভাবে প্রতিকূল সময়ে দলীয় কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন।
মাস্টার শাহজাহান ১৯৯০ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। প্রতারণাপূণ এই নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টি কাছে হেরে গেলেও মানুষের মনে স্থায়ী আসন গেড়েঁ বসেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন এবং একাধারে তিনবার উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১২ সালে সারাদেশের শ্রেষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সততা ও কর্মদক্ষতা স্বীকৃতি পান।
উজ্জ্বল এ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সফলতার কারণে বারবার প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়তে হয় মাস্টার শাহজাহান বিএ কে। তারি ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে বিএনপি জামাত অপশক্তি তার নিজ বাড়িতে সন্ত্রাসী হামলা চালাই। এবং মিথ্যা মামলা দায়ের করে, এই মিথ্যা মামলায় তাকে তিন মাস কারাবরণ করতে হয়।
উত্তর সন্দ্বীপ ডিগ্রী কলেজ, আবুল কাশেম হায়দার মহিলা কলেজ সহ আরো দুটি হাইস্কুল ও দুটি মাদ্রাসার সভাপতি ছিলেন মাস্টার শাহজাহান বিএ। আওয়ামী লীগের জন্য সারা জীবন উৎসর্গ করা মাস্টার শাহাজাহান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাঠেও ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। সন্দ্বীপের এতিমদের অভিভাবক হিসেবে সন্দ্বীপ এতিমখানার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
সমাজের প্রতিবন্ধী বিশেষ করে অন্ধদের এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সন্দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্ধকল্যান সমিতি এই সমিতির ও সভাপতি ছিলেন তিনি।
সন্দ্বীপে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় সন্দ্বীপ টাউন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন পুরাতন টাউনের ব্যবসায়ীদের বৃহত্তর এই সংগঠনেরও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাস্টার শাহজাহান বিএ।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মাস্টার শাহজাহান ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ ও নাট্য ব্যক্তিত্ব ক্রিড়ার ক্ষেত্রে তিনি ফুটবল ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায় দীর্ঘদিন রেফারির দায়িত্ব পালন করেন। নাট্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে সিরাজউদ্দৌলা মঞ্চনাটকে তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূমিকায় অভিনয় করেন।
২০০৬ সালে মাস্টার শাহজাহানের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয় বইটির নাম সন্দ্বীপের আওয়ামী লীগের অতীত বর্তমান।
২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে চার ছেলে ও এক মেয়ে রেখে যান।







