ডায়াবেটিসের উচ্চঝুঁকিতে ৭০ শতাংশ মানুষ

জীবনযাপনের ধরন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং কায়িক শ্রম কম করায় দেশের গ্রামাঞ্চলে  ডায়াবেটিকর হার বাড়ছে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামের ৭০ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরের মানুষের মধ্যে এই হার আরো বেশি হতে পারে।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে ঢাকা ও ময়মনসিংহের আট উপজেলায় ডায়াবেটিস নিয়ে এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষাটি পরিচালনা করে সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি।

২৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী ১১ হাজার মানুষের ওপর চালানো এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৩৩.২ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৫ বছর। ৩৬ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৫.৬ শতাংশ, ৪৬ থকে ৫৫ বছরের মধ্যে ২১.৫ শতাংশ এবং ৫৬ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে ১৯.৭ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

এমন পরিস্থিতিতে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে পালন করা হচ্ছে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। একই সঙ্গে আজ বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এবারের মূল প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধের এখনই সময়’। দিবসটি উপলক্ষে সকাল ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বারডেম ক্যাম্পাস এবং এনএইচএন ও বিআইএইচএসের বিভিন্ন কেন্দ্রসংলগ্ন স্থানে বিনা মূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হবে।

সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ২৯.৯ শতাংশ তামাক সেবন করে। ৬৭ শতাংশ কায়িক পরিশ্রম করে না। ৯৮.৯ শতাংশ দৈনিক পাঁচ ধরনের শাক-সবজি ও ফলমূল খায় না। ২০.৬ শতাংশের পারিবারিক ডায়াবেটিসের ইতিহাস আছে।

আরও পড়ুন:  অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যাণে লাগানোর আহ্বান রাষ্ট্রপতির

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ২৬ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায়।

এ ছাড়া জাতীয়ভাবে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। এতে ঝুঁকিপর্ণ মানুষ শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া সচেতনতার অভাবে রোগটি মহামারি আকার ধারণ করছে। অথচ শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও নিয়মিত কায়িক শ্রম দ্বারা ৫০ শতাংশ ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।

১৯৫৬ সালের এই দিনে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমসহ কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও গণ্যমান্য ব্যক্তির উদ্যোগে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সমিতির প্রথম বছরে রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৯। ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে শাহবাগে স্থানান্তরিত সমিতির কেন্দ্রীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট বারডেমে কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮ হাজার।

২০২৩ সাল শেষে শুধু বারডেমেই সাত লাখ ৩৮ হাজার ৯৯০ জন রোগী নিবন্ধিত হয়। এ ছাড়া দেশের ৬১টি জেলা ও ২৯টি উপজেলা পর্যায়ে এবং তিনটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে (ইব্রাহিম কার্ডিয়াক, এনএইচএন, এইচসিডিপি এবং বিআইএইচএস) নিবন্ধিত সর্বমোট ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ৭৩৬ রোগীর নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য মতে, বিশ্বে ৫৩.৭০ কোটি মানুষ বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রয়েছে। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে ৭০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ। বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ।

সেন্টার ফর গ্লোবাল হেলথ রিসার্চের প্রকল্প পরিচালক ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে চার বছরে একটি গবেষণায় দেখেছি, মাত্র ২০ শতাংশের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, পাশের দেশেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে।

আরও পড়ুন:  দেশের স্বার্থে কোনো অপশক্তিকে সহ্য করা হবে না: ওবায়দুল কাদের

ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক বলেন, ২০২২ সালে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী দুই হাজার ৪০০ মানুষের মধ্যে করা আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭.৪ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ১৫ থেকে ১৯ বছরের ৪.৪ শতাংশ। এদের মধ্যে সূ্থলতা ছিল ২৬ শতাংশের। রক্তচাপ ১৪ শতাংশের। গবেষণা আটটি গ্রাম ও আটটি শহরে করা হয়েছিল।

তিনি বলেন, দুই বছর আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি চারজনে একজন গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তাঁদের মধ্যে প্রথম এক বছরে ১৫ শতাংশের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে যাচ্ছে।

ডায়াবেটিস কী এবং কেন

ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের অভাব হলে বা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে গেলে রক্তের গ্লুকোজ দেহের বিভিন্ন কোষে প্রয়োজনমতো ঢুকতে পারে না। এতে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিকে ডায়াবেটিস বলে।

ডায়াবেটিস একবার হলে সারা জীবন থাকে। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে। টাইপ-১ ও টাইপ-২। বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ রোগীর টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের হার ৫ শতাংশ। সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সীদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস দেখা যায়। এ ধরনের রোগীর শরীরে ইনসুলিন একবারেই তৈরি হয় না। বেঁচে থাকার জন্য এসব রোগীকে ইনসুলিন নিতে হয়।

টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর শরীরের ইনসুলিন নিষ্ক্রিয় বা এর ঘাটতি থাকে। এ ধরনের রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও নিয়মিত ব্যায়াম অপরিহার্য। প্রয়োজনে ওষুধ খেতে হয় বা ইনসুলিন নিতে হয়।

নিয়ন্ত্রণে না রাখলে যেসব শারীরিক জটিলতা

পায়ে বা শরীরের অন্যান্য জায়গায় পচনশীল ঘা হতে পারে। পায়ে জ্বালাপোড়ার ভাব বা পা অবশ হয়ে যেতে পারে। কিডনির বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, বিশেষ করে টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে ২০ শতাংশের কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। স্ট্রোক বা হূদরোগের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। চোখের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে—এমনকি রোগী অন্ধ হয়ে যেতে পারে। নারীর ক্ষেত্রে অপরিণত বা শারীরিক ত্রুটিপূর্ণ বা মৃত সন্তানের জন্ম হতে পারে। মাড়ির প্রদাহ বা পেরিওডন্টাল ডিজিজ হতে পারে। যৌনক্ষমতা কমে যেতে পারে।

আরও পড়ুন:  বস্তুত, মেধাবীদের কোটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই

বারডেম জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক (একাডেমি) অধ্যাপক মো. ফারুক পাঠান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হূদরোগ, ৩৫ শতাংশ কিডনিজনিত সমস্যা এবং একই হারে চোখ ও স্নায়ুর সমস্যায় ভুগছে। এসব জটিলতার কারণে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে।

মো. ফারুক পাঠান বলেন, চর্বিযুক্ত খাদ্যাভ্যাসের কারণে ১১ থেকে ২৬ শতাংশ ডায়াবেটিস ঝুঁকি বাড়ে, কায়িক পরিশ্রম না করলে ঝুঁকি বাড়ে ২০ শতাংশ। অতিরিক্ত শর্করাজাতীয় খাবারে ১৮ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রোগ বাড়ে। ঘন ঘন কোমল পানীয় পানে বাড়ে ২৬ শতাংশ। এক ঘণ্টা টিভি দেখলে বাড়ে ৩-৪ শতাংশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *