এক বুক সমুদ্র নিয়ে ভালোবাসতে বলতেন হুমায়ুন ফরীদি

‘তুমি যখন কাউকে ভালোবাসবে, এক বুক সমুদ্র নিয়ে তাকে ভালোবাসবে। তা নাহলে প্রেমের কোন অর্থ নাই।’ ভালোবাসা নিয়ে প্রখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির করা উক্তিটি আজ সবার মধ্যে থাকলেও সেই মানুষটি আজ নেই। সমুদ্রের মতো ভালোবাসা অর্জন করে ১২ বছর আগে হুট করে চলে গেছেন অভিনয়ের এই বাতিঘর।  বেঁচে থাকলে ৭০ বছর ছুঁতেন তিনি। আজ হুমায়ুন ফরীদির মৃত্যু বার্ষিকী।

১৯৫২ সালের এই দিনে ঢাকার নারিন্দায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র- তিন মাধ্যমেই ছিল তার সমান পদচারণা। তিন দশকের বর্ণিল ক্যারিয়ারে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক জনপ্রিয় নাটক ও চলচ্চিত্র।

জন্ম ঢাকায় হলেও শৈশব-কৈশোরে বাবার চাকরির সুবাদে ঘুরতে হয়েছে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ আরও অনেক জেলায়। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্কুলে। চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করেন ১৯৭০ সালে। এরপর একই বছর স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়ন বিভাগে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর পেশা হিসেবে বেছে নেন অভিনয়। যদিও ছাত্রজীবন থেকেই মঞ্চ নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন:  সৎ ও সাহসী শ্রমিক নেতা কাজী মোহাম্মদ সাঈদ

১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জে মহল্লার একটি নাটকে অভিনয় করে তার অভিষেক হয় । স্কুল জীবনেই ‘ভূত’ নাটকে নির্দেশনা। এরপর ঢাকার মঞ্চে ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকগুলোতে তার অভিনয় কেবল প্রশংসিতই হয়নি, হুমায়ুন ফরিদীকে করে তুলেছে অনন্য।

টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদি প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এ। এরপর ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চাঁনমিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘নীল আকাশের সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, ‘তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘শৃঙ্খল’, ‘ভবের হাট’ এসব নাটকের তার অভিনয় তাকে শুধু পরিচিতই করেনি, করে তুলেছে তুমুল জনপ্রিয়।

আরও পড়ুন:  দেশকে ধ্বংস করার যেকোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকুন : প্রধানমন্ত্রী

টেলিভিশন কিংবা মঞ্চে সেলিম আল দীন এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গেই ছিল এ অভিনেতার সর্বাধিক সংখ্যক কাজ। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গেও অনেক নাটকে কাজ করেছেন হুমায়ুন ফরিদী। বিশেষ করে হুমায়ুন আহমেদের ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকে হুমায়ুন ফরীদি অভিনীত চরিত্র ‘কানকাটা রমজান’ এখনও দর্শকমনে দাগ কেটে আছে।

6

চলচ্চিত্রেও হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন বেশ জনপ্রিয়। তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’ দিয়েই এ মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু। শহীদুল ইসলাম খোকন পরিচালিত ‘সন্ত্রাস’ দিয়ে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে তার সাফল্যগাঁথা শুরু। এরপর ‘ভণ্ড’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামলছায়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মায়ের র্যোদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ও ‘পালাবি কোথায়’সহ আরও অনেকগুলো ছবি হুমায়ুন ফরিদীকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। তার অভিনীত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই ছিল সুপারহিট।

বিশেষ করে খলচরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় এখনও দর্শকচোখে তৃপ্তি জুড়ায়। ‘মাতৃত্ব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০০৪ সালে সেরা অভিনেতা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান এ অভিনেতা। ২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট মুক্তি পাওয়া উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘এক জবানের জমিদার, হেরে গেলেন এবার’ ছিল তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র।

আরও পড়ুন:  একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে বিলম্ব কেন?

অভিনয় করলেও লেখালেখির প্রতি তেমন কোনো দুর্বলতা ছিল না হুমায়ুন ফরিদীর। নির্মাণের প্রতি আগ্রহ থাকলেও অভিনয় ব্যস্ততার কারণে সেখানেও খুব বেশি দেখা যায়নি তাকে। তবে কয়েকটি টেলিফিল্ম, ধারাবাহিক ও এক ঘণ্টার নাটক নির্মাণ করেছেন এ অভিনেতা।

8

ব্যক্তিজীবনে বেশ সাদামাটা মানুষ ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। ফরিদপুরের মেয়ে মিনুকে বিয়ে করেই শুরু করেন সংসার জীবন। কিন্তু সেটার বিচ্ছেদ ঘটে। সে ঘরে দেবযানি নামে তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।

এরপর প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে ঘর বাঁধেন এ অভিনেতা। কিন্তু ২০০৮ সালে তাদেরও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর থেকে ২০১২ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একাই দিনযাপন করেছেন প্রখ্যাত এ অভিনেতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *