যেসব দ্বন্দ্বের কারণে ইরান-পাকিস্তানের সংঘাত

বেলুচিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ আল-আদল নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ইরান ও পাকিস্তান। ইসলামাবাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন ও বেলুচি জঙ্গি গোষ্ঠীর দুটি ঘাঁটিতে একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান। অপরদিকে ‘গুরুতর পরিণতির’ হুঁশিয়ারি দিয়ে ইরানেও  হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান।

বেলুচিস্তান হল পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ। এই অঞ্চল থেকেই পাকিস্তানের ৪০ শতাংশ গ্যাস উৎপাদিত হয়। পাশাপাশি চীনের ‘চায়না পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ চেকপয়েন্ট এই প্রদেশ। এখানকার ওমান উপসাগরের কাছে রয়েছে গোয়াদর বন্দর। কৌশলগত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও, এই অঞ্চলটিকে অনেকটাই উপেক্ষা করে আসছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনকি ১৯৪৮ সালে প্রদেশটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই স্বাধীনতার আন্দোলন করে আসছে।

বেলুচিস্তান অঞ্চলের একটি সম্প্রদায় হলো বেলুচ উপজাতি। ‍এলাকাটি তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। উত্তরের অংশ বর্তমান আফগানিস্তানে,  পশ্চিমাঞ্চল ইরানে যাকে বলা হয় সিস্তান-বেলুচিস্তান অঞ্চল এবং অবশিষ্টাংশ পাকিস্তানে। ব্রিটিশ শাসনামলে এবং তার পরেও এই অঞ্চলটি ক্ষমতার লড়াইয়ের কেন্দ্রে ছিল ও রয়েছে।

ব্রিটিশরা ‘স্যান্ডেম্যান সিস্টেমে’ এই অঞ্চল শাসন করত। এই অঞ্চলে ‘সর্দার’ বা ‘জিরগার’ নিয়ন্ত্রিত উপজাতিদের স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে পরোক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রবার্ট গ্রোভস স্যান্ডেম্যান এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। বেলুচ উপজাতিদের বলা হতো ‘স্যান্ডেমাইজেশন’। পাকিস্তান ১৯৪৮ সালে এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

আরও পড়ুন:  আমরা শুধু জিতব, জিতব এবং জিতব : ট্রাম্প

বেলুচিদের বিশ্বাস, বিভাজনের পর তারা পাকিস্তানের উপনিবেশেই থেকে যায়। এমনকি পাঞ্জাবি, সিন্ধিদের মতো তারা পাকিস্তানের রাজনীতিতে এতটাও প্রভবাশালী হয়ে উঠতে পারেনি। আফগানিস্তানের সঙ্গে পশতুন অঞ্চলের সখ্যতা ও স্বাধীনতাকামী বেলুচিরা পাকিস্তানের ‘অ্যাকিলিস হিল’ বা দুর্বল পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। মূলত এই অঞ্চলকে স্বাধীন করার জন্যই বেলুচ সশস্ত্র বিদ্রোহীম গোষ্ঠীর গোড়া পত্তন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বেলুচ জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষও হয়েছে। তারা এই অঞ্চলের নানাবিদ উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা দিতে বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে বিশেষ করে চীনা অবকাঠামোতে।

সীমান্তের উভয় পাশে বেলুচিরা স্বাধীন হওয়ার জন্য ক্ষুধার্ত। স্বাধীনতা ও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এবং রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধির কারণে মাদক-অস্ত্র চোরাচালানের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে অঞ্চলটি।

ইরানে সমস্যা

বেলুচিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলকে (বর্তমানে সিস্তান-বেলুচিস্তান) ইরানের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন রেজা শাহ পাহলভি। ১৯৭০ এর দশকে ইরান ইসলামিক বিপ্লব ও কাজার রাজবংশের পতনের পর শিয়া শাসনের অধীনে চলে আসে। সুন্নি মতাদর্শের হওয়ায় তাই বেলুচদের উপেক্ষাই করা হয়েছে খোমেনির নেতৃত্বে।

আরও পড়ুন:  গাজায় চরম মানবিক বিপর্যয়, ৪৮ ঘণ্টায় গেল প্রাণ ৯৭০

ইরানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এই প্রদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটাই শোচনীয়। বিশেষ করে ইরান ও পাকিস্তানের অন্য অংশের তুলনায় এই প্রদেশের মানুষ সুবিধা বঞ্চিত।

বছরের পর বছর অবহেলা ও দমন-পীড়নের কারণে ইরানেও একটি প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং সুন্নি বালকুহি জঙ্গি গোষ্ঠী যেমন, জুনদুল্লাহ ও জাইশ-আল আদলের জন্ম হয়। তারা পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এই অঞ্চলের উভয় প্রান্তের মানুষ একে অপরকে সাহায্য করে এবং সীমান্তের উভয় পাশে তারা জঙ্গি গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে।

তাই বলা হয় দুই দেশের একই সমস্যা বেলুচি জঙ্গিবাদ। তারা অতীতেও জঙ্গিবাদ দমনে একমত হয়েছে। ২০১৯ সালে জইশ আল-আদল ইরানী বিপ্লবী গার্ড কর্পসের ২৭ সদস্যকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে।

এবারই প্রথম নয়

অতীতে এমন নজির রয়েছে যেখানে ইরান বেলুচিস্তানে জঙ্গি শিবিরে হামলার জন্য মর্টার নিক্ষেপ করেছে। ইরান-পাকিস্তান সীমান্তে একটি বেড়া এখন পরিবার ও উপজাতিকে আলাদা করেছে, যা এখনও আছে।

সাম্প্রতিক হামলা দুটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে—একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশের আকাশসীমা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা এবং বেলুচিস্তানে অস্থিরতা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে জড়িত ক্ষমতা রাজনীতির মাধ্যমে লঙ্ঘন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন:  শেখ হাসিনা একজন স্ট্রং লেডি: ভারতের রাষ্ট্রপতি

জইশ আল-আদলকে চির প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরবের প্রক্সি হিসেবে বিবেচনা করে ইরান। সৌদির সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা ইরানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সুন্নি মতাদর্শী হওয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠীটি আল-কায়েদা ও তালেবানের মদদপুষ্ট বলে অভিযোগ ইরানের। এর উত্থানের পেছনে পাকিস্তানকেও দায়ী করে তেহরান। যদিও প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যা উভয় দেশকেই মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দর ও ইরানের চাবাহার বন্দর বেলুচিস্তান অঞ্চলে রয়েছে। দুটি বন্দরকে সিস্টার পোর্ট বলে ডাকা হয়। ইরানের মূল দায়িত্ব চাবাহার সুরক্ষিত করা ও সিস্তান-বেলুচিস্তানে অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে রাখা। চাবাহার ও গোয়াদর হল যোগাযোগের সমুদ্র সংযোগে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *