আহসান ইমাম
বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল জনতার মহানগরে। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে বেলা ১টা ৪১ মিনিটে জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মাটিতে পর্দাপণ করেন বীরের বেশে। ঐ মুহূর্তটির ঐতিহাসিক একটা মর্যাদা আছে। আমি মনে করি- বাঙালি জাতির ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ সূচনা হয়েছিল ঠিক ঐ মুহূর্ত থেকেই।
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য দিন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। পাকিস্তানের কুখ্যাত মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে বন্দি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন- স্বদেশ, মুক্ত নতুন বাংলাদেশে। মহাপুরুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আনন্দধারা বয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশে। তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান। তারপর দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রিয় নেতার ফিরে আসায় ঐতিহাসিক গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়। এ যেন ঘরের ছেলের ঘরে ফিরে আসা।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় যুদ্ধ তথা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’। স্বাধীন বাংলাদেশের জনতা প্রিয় পিতার আহ্বানে সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধবিধস্ত দেশ গঠন এবং বাঙালি জাতিকে নতুন করে আবারও জাগ্রত হওয়ার শপথ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ শপথ ছিল সোনার বাংলাকে নতুন করে সাজিয়ে নেয়ার। পাকিস্তানি হানাদারদের শোষণ-নির্যাতনের কবল থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের ‘প্রথম বিপ্লবের’ পর তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ মাধ্যমে এ দেশ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য দূর করে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেন।
ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে সচেতন করে। ইতিহাস আর কিংবদন্তি একসঙ্গে হাত ধরে চলে। সব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীবার্দ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আজ ইতিহাস। এ ইতিহাসের কিংবদন্তি নায়ক স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। যে নেতার একক নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের ফসল, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে পেয়েছিল পুরো বাঙালি জাতি।
দরদী, সোনার বাংলার কারিগর। এ নেতা মহাবাঙালি ছিলেন একজন আত্নপ্রত্যয়ী, উন্নত চেতনাসমৃদ্ধ মানব। তার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে অন্য কোনো বাঙালির কন্ঠস্বরের মিল ছিল না। তার কণ্ঠের মাধ্যমে অগ্নিবীণা নিঃসৃত হতো। তাই সাধারণ মানুষ তার কণ্ঠকে বজ্রকণ্ঠ বলে অভিহিত করেছে। তার কণ্ঠই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের ভীত করে তুলেছিল। তার ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান মানুষের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিতো। তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নেতা, যিনি তার জীবদ্দশায় স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছিলেন। মাত্র তিন বছর সাত মাসে তিনি বাংলাদেশকে অনেকাংশে সোনার বাংলা হিসেবে গড়তে সক্ষম হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারে তার দূরদর্শিতা অনুকরণীয় ছিল। তিনি ছিলেন আর্থ-সামাজিক মুক্তির দিক-নির্দেশক। তিনি দেশে এমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যাতে সাধারণ জনগণ অংশ নিতে পারে এবং বৈষম্যের অবসান ঘটে। তিনি ছিলেন শোষিতের পক্ষে। তিনি চেয়েছিলেন মানুষের অধিকার। তার অসমাপ্ত কাজই তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সমাপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সেই ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ কাজ আজও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়