অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে পবিত্র কুরআনের প্রথম তেলাওয়াতকারী, বাংলাদেশে বয়স্ক শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা আন্দোলনের পথিকৃৎ, বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল সন্দ্বীপ উপজেলার মাইটভাঙ্গা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মনু বেপারির বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা-মুন্সি নুর আহমদ, মাতা-আমিরুন নেসা।
শিক্ষাজীবন-
তিনি ১৯৫৯ সালে সাউথ সন্দ্বীপ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে এম.এ পাস করেন। ১৯৭৪ সালে ভারত থেকে কো-অপারেটিভ বিষয়ে ফেলোশিপ ও ১৯৭৫-১৯৭৬ সালে সৌভিয়েত রাশিয়া থেকে ডিপ্লোমা পাস করেন।
ছাত্র রাজনীতি-
১৯৬২-১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা হিসেবে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস, ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের সাহিত্য সম্পাদক, ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ‘অন্বেষা’ বার্ষিকীর সম্পাদক, ১৯৬৬-১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মজীবন-
১৯৬১-৬২ সালে সমাজকল্যান বিভাগের অধীনে শহর উন্নয়ন প্রকল্প চট্টগ্রামে বয়ষ্ক নৈশ বিদ্যালয়ের পরিদর্শক, ১৯৬৩-৬৫ সালে একই প্রকল্পে শিক্ষক, পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালক, ভিলেজ এডুকেশন রিসার্স সেন্টারের সমন্বয়কারী ও উপ-পরিচালক এবং গণসাহায্য সংস্থায় চাকুরি করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্থানের একমাত্র বয়স্ক শিক্ষা সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাঁর বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পের বিস্তৃতি ও স্বাক্ষরতা বৃদ্ধির আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে বিস্তার লাভ করে।
উপাধ্যক্ষ-
১৯৭০ সালের জুন থেকে ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত তিনি ফটিকছড়ি কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সাংবাদিকতা-
১৯৬১-১৯৭১ দৈনিক আজাদী’র আগামীদের আসর এর পরিচালক ছিলেন। একই সময়ে কাজ করেন দৈনিক ‘জমানা’-তে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-
১৯৬২-১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলন ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সদস্য এবং ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটির আহবায়ক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
সন্দ্বীপ সন্দর্শন-
১৯৬৯ সালে শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর যৌথ সম্পাদনায় ‘সন্দ্বীপ সন্দর্শন’ প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমি অধ্যক্ষ মুকতাদের আজাদ খান এর তত্ত্বাবধানে বইটি পুনর্মুদ্রণ হয়।
তালিকাভুক্ত গীতিকার-
মহান মুক্তিযুদ্ধে বহুল প্রচারিত গান ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ এর গীতিকার তিনি। ১৯৬০-এর দশক থেকে তিনি চট্টগ্রাম বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও নিয়মিত লেখক এবং চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র-
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি, বেলাল মোহাম্মদ, সুলতানুল আলম, আবদুস সালাম, আবদুল্লাহ আল ফারুক সহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। তিনিই এই কেন্দ্রের প্রথম সংবাদ পাঠক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আগরতলা ও কলকাতায় সংবাদ লেখার দায়িত্ব পালন করেন এবং বেতারে বাংলা খবর পাঠ করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টা ৪০ মিনিটে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যতদিন থাকবে ইতিহাসের পাতায় তাঁর নাম ততদিন থাকবে।
বিভিন্ন দেশে সফর-
তিনি সৌভিয়েত ইউনিয়ন, গণচীন, কিউবা, ভারত, থাইল্যান্ড, জাপান, ফিলিপাইন, হংকং প্রভৃতি দেশ সফর করেন।
সম্মাননা-
মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে অবদানের জন্য আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ১৯৭৫ সালে ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’, ১৯৮৩ সালে ‘ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক স্বাক্ষরতা পদক’, ১৯৮৪ সালে ‘জাতীয় স্বাক্ষরতা পদক’, ১৯৮৫ সালে ব্যাংককভিত্তিক ‘নাসিম-হাবিব পদক’, ১৯৮৬ সালে ‘আজিজুর রহমান পাটওয়ারী স্বাক্ষরতা পদক’, স্বাধীনতা ও স্বাক্ষরতায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৯৮ সালে ‘একুশে পদক’ (মরনোত্তর) এবং ২০০২ সালে ‘চাঁদ সুলতানা স্বাক্ষরতা পুরস্কার’ (মরনোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবন-ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমির উন নূর লিয়েনা নামক এক কন্যা সন্তানের পিতা।
ইন্তেকাল-তিনি ১৯৯৫ সালের ১০ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তথ্যঋণ: সন্দ্বীপ : শিক্ষা-সমীক্ষা ও উইকিপিডিয়া।
লেখক-অধ্যক্ষ, তাহের-মনজুর কলেজ, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *