‘আমাদের বাড়ি’ একটি মানবিক ঠিকানা

সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও প্রবীণরা সমাজের বোঝা নয় বরং তারা সম্পদ। আর এই সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও প্রবীণরা যাতে সমাজের অবহেলার পাত্র না হয়, সেজন্য যশোরে নির্মিত হয়েছে শিশু ও প্রবীণদের জন্য সমন্বিতভাবে তৈরি প্রবীণ ও শিশু নিবাস ‘আমাদের বাড়ি’। প্রতিষ্ঠানটিতে এলাকার শতাধিক ছেলে-মেয়ের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।

সচ্ছল-অসচ্ছল, প্রবীণ-শিশু—সবাইকে এক ছাতার নিচে এনে বসবাসের অনন্য এক পল্লী গড়ে উঠেছে যশোর সদরের নাটুয়াপাড়ায়। ‘আমাদের বাড়ি’ নামের সমন্বিত এ উদ্যোগ বাংলাদেশে এই প্রথম। যশোরের সন্তান, ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডা. এমএ রশিদ আমাদের বাড়ির স্বপ্নদ্রষ্টা। তার ঐকান্তিক পরিশ্রমের ফসল এ প্রবীণ ও শিশু নিবাস ‘আমাদের বাড়ি’।

যশোর সদর উপজেলার নাটুয়াপাড়ায় সমন্বিত প্রবীণ ও শিশু নিবাস নামে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের যৌথ অংশিদায়িত্বে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়েছে। ২০১৭ সালের ১০ আগস্ট আমাদের বাড়ির স্বপ্নের বীজ বপন হয়।

যশোর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে এটি অবস্থিত। ৮০ শতাংশ সরকারের এবং ২০ শতাংশ জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের। গ্রামীণ মনোরম পরিবেশে ১ একর ৫ শতক জমির উপরে নির্মিত এই প্রতিষ্ঠানে ৪ তলা ভবনে ১৫০ জন বসবাস করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতিয়ার রহমান।

আরও পড়ুন:  মেসির একাধিক গোল মিস, তবু্ও জয় দিয়ে শুরু আর্জেন্টিনার

প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত প্রবীণ ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য, ব্যায়ামাগার। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। সেই সাথে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনায় ৯ বিঘা জমিতে ৫টি মাছের খামার, হাঁস মুরগি, গরু-ছাগলের খামার ও ১৭ বিঘা জমিতে ধান সবজি চাষের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

‘আমাদের বাড়ি’র উদ্যোক্তা জিএমএসএস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এমএ রশিদ জানান, সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবারের ছেলেমেয়েরা দেশে-বিদেশে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছে। বাড়িতে থেকে যাচ্ছেন প্রবীণরা। তারা হয়ে পড়ছেন অবহেলিত। তাদের দেখার কেউ থাকছেন না। আবার বাড়ি থেকে মা-বাবা কর্মস্থলে গেলে দাদা-দাদি, নানা-নানির কাছে রয়ে যাচ্ছে শিশুরা। ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরও দেখভালের কেউ থাকছে না। এজন্য দাদা-দাদি, নানা-নানি, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে এখানে থাকার সুযোগ পাবেন। তারা সারাদিন এখানে থেকে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। আবার এখানেও আবাসিক সুবিধায় থাকতে পারবেন।

অধ্যাপক রশীদ বলেন, সমাজের আরেকটি বড় অংশ অবহেলিত শিশুরা। এদের আমরা অনাথ বা এতিম বলছি না। যথাযথ সুবিধার অভাবে এরা মাদকাসক্তসহ নৈতিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। এসব শিশুকেও এখানে নিয়ে এসে যত্নের সঙ্গে গড়ে তোলা হবে— যেন তারা বিপথগামী হতে না পারে।

আরও পড়ুন:  একসঙ্গে সাত বউ নিয়ে সংসার করছেন কুষ্টিয়ার রবিজুল

তিনি আরো বলেন, এখানে তারা শুধু থাকবে, শুবে আর খাবে, ব্যাপারটা এমনও না। এ কম্পাউন্ডের চারপাশ জুড়ে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাইস্কুল, মহিলা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে তারা লেখাপড়া শিখতে পারবে। প্রবীণদের জন্য এখানে ব্যবস্থা আছে কৃষিকাজ, বাগান করা, পোলট্রি, গরু-ছাগলের খামার, মাছ চাষের মতো কাজে যুক্ত থাকার সুযোগ। রয়েছে শরীরচর্চা, প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার সব সুবিধা। এমনকি ইসিজি, এক্স-রেসহ প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, বার্ষিক স্বাস্থ্য চেকআপ, জরুরি প্রয়োজনে নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে শহরের দুটি হাসপাতালের সঙ্গে করা চুক্তির আলোকে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসুবিধার ব্যবস্থা। ছোট-বড় সবার জন্যই রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

বিগত এক দশক আগেও দেশে অর্ধ কোটি ভূমিহীন পরিবার ছিল। বর্তমান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ হাতে নেয়। এতে ভূমিহীন গৃহহীন মানুষকে দুই শতক জমিসহ ঘর দেওয়া হয়। উপকারভোগী ও পুনর্বাসনের পদ্ধতি বিবেচনায় এটি বিশ্বের এখন বৃহত্তম সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচি।

আরও পড়ুন:  নিরাপত্তাবলয় ভেঙে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৮ লাখ ২৯ হাজার ৬০৭টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পুনর্বাসিত মানুষের সংখ্যা ৪১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫ জন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প ইতিমধ্যে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭ পরিবারকে সরাসরি পুনর্বাসন করা হয়েছে। ভুমি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সহ সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচির অধিনে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সরকারের পাশাপাশি যদি বেসরকারি উদ্যোগে যদি ‘আমাদের বাড়ি’র মতো এমন মানবিক আঙ্গিনা গড়ে উঠে তাহলে এদেশে আর গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষ থাকবে না এমনটা সকলের প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *