হিমুর মৃত্যু রহস্যেও আসছে একই নাম

অভিনেত্রী হুমায়রা হিমুর মৃত্যু রহস্যকে কেন্দ্র করে ঘুরেফিরে একটি নাম আসছে তা হচ্ছে মেকআপ আর্টিস্ট মিহিরের। ২০১৮ সালে অভিনেত্রী তাজিন আহমেদের মৃত্যুর পরেও মিহিরের নামটি সামনে এসেছিল।

জানা গেছে, অভিনেত্রী তাজিন আহমেদের মৃত্যুর আগে একইভাবে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন এই মিহির। বছর পাঁচেক পর আবার একই ঘটনার অন্যরকম পুনরাবৃত্তি।

২০১৮ সালের ২২ মে দুপুর ১২ টার দিকে নিজ উত্তরার বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন  তাজিন আহমেদ। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে কিছু সময় পর তার মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত জানা যায়— হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।

এ ঘটনার প্রায় ৫ বছর ৫ মাস পর গত বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) উত্তরার বাসায় অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু আত্মহত্যা করেছেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। যদিও হাসপাতালে নেওয়ার পরই হিমুর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন সবাই।

তাজিন ও হিমুর এমন অসহায় মৃত্যু নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। যার জবাব খুঁজতে গিয়ে ভুল তথ্যের গুজবে ছড়িয়েছে অনেক বিভ্রান্তি এবং এখনো তা চলমান রয়েছে। তবে কাকতালীয়ভাবে এ দুই অভিনেত্রীর শেষ মুহূর্তে তাদের পাশে ছিলেন মেকআপম্যান মিহির। এমনকি দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসকের মৃত ঘোষণা পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন মিহির। এককথায় তাদের পুরো মৃত্যুর ঘটনাটি দেখেছেন একজন মেকআপম্যান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মৃত্যুর আগে অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ একা থাকতেন। একই অবস্থা ছিল অভিনেত্রী হিমুর ক্ষেত্রেও, নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করতেন এ অভিনেত্রী।

মৃত্যুর সময় স্বজন-পরিজন কেউই পাশে ছিল না তাজিনের। একই দৃশ্য দেখা যায় অভিনেত্রী হিমুর ক্ষেত্রেও। তবে শেষ সময়ে দুজনেরই পাশে ছিলেন মিহির।

আরও পড়ুন:  প্রকাশ পেল তাদের গান ‘ক্ষমা চাই’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিল্পী জানান, বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি— মিহির নিঃসঙ্গ অভিনয়শিল্পীদের পাশে থাকে। তাদের যে কোনও বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ান। তাজিন ও হিমুর সব তথ্য, জীবনের কষ্ট- সব কিছু মিহির জেনে থাকতে পারে।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরে হিমুর বাসায় থাকতেন মিহির। হিমুর দেখাশোনার দায়িত্বেও তিনি ছিলেন।

মিহিরকে অনেক অভিনেত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে দাবি করছেন অনেকে। বিশেষ করে নারী অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বেশি। এদিকে মৃত্যুর আগে হিমু নিজেকে সবকিছু থেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন অভিনেত্রী তাহমিনা সুলতানা মৌ।

মিহিরকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতের বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে উনার(মিহির) নাম বারবার আসছে। এটা একটু তদন্ত করে দেখা উচিত। আমার তার সঙ্গে তেমন একটা কাজ করা হয়নি। তিনি(মিহির) হিমুর সঙ্গে ক্লোজ ছিলেন, তাজিন আপার সঙ্গে ক্লোজ ছিলেন। আমার মনে হয় তার সঙ্গে কথা বললে জানা যাবে বিষয়টা আসলে কি? যেহেতু তার নাম বারবার উঠে আসছে। বিষয়টি তদন্ত করা উচিত।

এ প্রসঙ্গে উপস্থাপক ও অভিনেতা শাহরিয়ার নাজিম জয় এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মেকআপ আর্টিস্ট মিহির এক সময় অভিনেত্রী শ্রাবন্তীর ব্যক্তিগত মেকআপ আর্টিস্ট ছিল। আমরা তখন নিয়মিত কাজ করতাম। শ্রাবন্তী তখন প্রথম সারির নায়িকা। শ্রাবন্তী যখন মিহিরকে নিতো তখন মিহিরের অনেক দাপট ছিল। শ্রাবন্তীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিহিরেরও অবস্থান পরিবর্তন হয়। তারপর মিহিরকে তাজিন আপার সঙ্গে পাই। তাজিনের মৃত্যুর ঘটনার সময়ও মিহির ছিল। একইভাবে হুমায়ারা হিমুর মৃত্যুর ঘটনায়ও মিহির ছিল।’

আরও পড়ুন:  সালমান শাহর চলে যাওয়ার দিন আজ

তিনি আরও বলেন, হিমুর সব তথ্য, জীবনের-যাপনের কষ্ট, সব কিছু মিহির জানে। মিহিরকে ডিবি বা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আনা উচিত। তাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে- এটা কি অপমৃত্যু, না অন্য কিছু।

মেকআপ আর্টিস্ট মিহির মিডিয়াপাড়ায় পরিচিত নাম। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এ অঙ্গনে কাজ করছেন। মেকআপম্যান হিসেবে তার বেশ নামডাক রয়েছে। তবে একাধিক শিল্পীর ব্যক্তিগত মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

মিহিরের বাড়ি সিলেটে। ব্যক্তিগত জীবনে একাধিকবার বিয়ে করেছেন বলে জানা গেছে। একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে দুবার বিয়ে করেছেন মিহির। আত্নহত্যায় তার দুই স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে।

হুমায়রা হিমু ১৯৮৫ সালের ২৩ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইস্পাহানি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম নাট্য জগতে প্রবেশ করেন। ফ্রেঞ্চ নামক নাট্য দলের হয়ে তিনি অভিনয় করেন। ২০১১ সালে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে হুমায়রা হিমুর অভিষেক হয়। চলচ্চিত্রের গল্পটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি এবং চলচ্চিত্রে তার অসাধারণ অভিনয় সমালোচকদের ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিল।

হুমায়ারা হিমুর মামা ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক মঈন উদ্দিন চৌধুরী বলেন, হিমুর বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। হিমু বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা প্রকৌশলী সানা উল্লাহ গত আগস্ট মাসে মারা যান। তার মা শামীম আরা চৌধুরী ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। হিমুর মরদেহ তার মায়ের কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ১৯৮১ সালে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার বাসিন্দা সানা উল্লাহর সঙ্গে হিমুর মায়ের বিয়ে হয়। হিমুর জন্মের পরেই তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর থেকেই হিমুকে নিয়ে তার মা লক্ষ্মীপুরে থাকতেন। কখনো দাদার বাড়িতে যাওয়া হয়নি তার।

আরও পড়ুন:  ৩০০ কোটির দ্বারপ্রান্তে ‘অ্যানিমেল’

অন্যদিকে তাজিন আহমেদের মা দিলারা জলির প্রোডাকশন হাউস ছিল। তার হাত ধরেই মিডিয়ায় যাত্রা শুরু অভিনেত্রীর। দীর্ঘদিন থিয়েটারেও কাজ করেছেন। তার সর্বশেষ অভিনীত মঞ্চ নাটক ‘ময়ূর সিংহাসন’।

‘শেষ দেখা শেষ নয়’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাজিনের টেলিভিশনে অভিনয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। নাটকটি ১৯৯৬ সালে বিটিভিতে প্রচার হয়। হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘নীলচুড়ি’তে অভিনয় করেও বেশ আলোচিত হন। তার সর্বশেষ অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘বিদেশি পাড়া’।

তাজিন আহমেদ রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)’-এ যোগ দিয়েছিলেন। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির বিভাগীয় সম্পাদক (সাংস্কৃতিক) পদে দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।

জীবনের নানা টানাপোড়েনের কারণে আস্তে আস্তে মিডিয়া ছেড়ে নিবৃত্ত জীবনে চলে যান তাজিন। মা দিলারা জলি চেক ডিজঅনারের মামলায় কারাগারে চলে গেলে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। দাম্পত্য জীবনেও সফল ছিলেন না এ অভিনেত্রী। প্রথমে নাট্য নির্মাতা এজাজ মুন্নাকে বিয়ে করলেও সেই সংসার বেশিদিন টেকেনি। পরে সঙ্গীতশিল্পী ও পরিচালক রুমি রহমানের সঙ্গে সংসারজীবনে আবদ্ধ হলেও একটা সময় পর তারা একসঙ্গে থাকতেন না বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *