মোহাম্মদ ফয়সাল আলম:
বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি বিভাগের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পিডিবির আর্থিক অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় আইএমএফ। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তা কী করে সমন্বয় করা হবে, সেটিও জানতে চেয়েছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। দীর্ঘ সময় চলা এ বৈঠকে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি তুলে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারের কী পরিমাণ ব্যয় করতে হচ্ছে; এ নিয়ে সরকারের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোসহ অন্যান্য সংস্কারমূলক কর্মসূচির অগ্রগতি কতটুকুÑ বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আইএমএফের বাংলাদেশ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এতে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ক্যাপাসিটি চার্জের পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ও আয়ের অবস্থা এবং এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এদিন বিকালে পিডিবির সঙ্গে বৈঠক করেন আইএমএফ প্রতিনিধিরা। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ প্রতিনিধি দল পিডিবির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে পিডিবির কর্মকর্তারা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেন। সার্বিক চিত্র দেখে সন্তুষ্ট নয় আইএমএফ প্রতিনিধি দল। আর্থিক রুগ্্ণদশা থেকে পিডিবির উত্তরণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তারা।
পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফের প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে, ট্যারিফ বৃদ্ধি করে আর্থিক সংকট থেকে, বিশেষ করে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত রবিবার প্রতিনিধি দলটি জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবের সঙ্গে এবং গত বুধবার পেট্রোবাংলা ও বিপিসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে জ¦ালানি খাতের সামগ্রিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চায়। এসব বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে ভর্তুকি কমানোর বিষয়েই মূলত তাগিদ দিচ্ছে আইএমএফ। ভর্তুকি কমাতে গেলে দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হলে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়বে ভেবে আপাতত দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশকে শর্তসাপেক্ষে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে আইএমএফ। এ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি প্রদানের আগে সংস্থাটির দেওয়া শর্তাবলি পূরণের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতে আইএমএফের বাংলাদেশ মিশন প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি দল গত ৪ অক্টোবর ঢাকায় এসেছে। দলটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকের পর ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ত্যাগ করার কথা রয়েছে।
সূত্রমতে, বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেনÑ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রির ফলে সরকারকে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এ মুহূর্তে মূল্য সমন্বয়ে কী পরিকল্পনা রয়েছে? এ ছাড়া পিডিবির আর্থিক অবস্থা, বিদ্যুৎ ঘাটতি, বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি, নবায়নযোগ্য জ¦ালানি পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা করেছে প্রতিনিধি দলটি।
বিদ্যুৎ বিভাগ আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছে, তুলনামূলক সাশ্রয়ী দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার কাজ করছে। নবায়নযোগ্য জ¦ালানি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। বেসরকারি খাতের যেসব কেন্দ্রগুলোকে নবায়ন করা হচ্ছে সেগুলো থেকে বর্তমানে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ শর্তে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। ফলে এখানে কোনো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া লাগছে না। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কীভাবে কমানো যায় সেজন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এগুলো বাস্তবায়ন করতে কিছুটা সময় লাগবে।
বিদ্যুৎ খাতে ২০২২ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির কারণে সরকারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ২০১৮ সালে এই ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বর্তমানে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রায় ৫ টাকা লোকসান করছে, যা সরকার ভর্তুকি দিয়ে সমন্বয় করছে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকারকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ধাপে ধাপে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে হবে। এর অংশ হিসেবে, সরকার কয়েক দফায় বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করেছে। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের দাম এবং ১৮ জানুয়ারি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য আইএমএফের শর্ত পূরণ করা এবং খাতে আর্থিক ক্ষতি কমানো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কারণে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে যদি বাংলাদেশের বিলম্ব হয়, তাহলে জরুরি আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও অনেক কাটছাঁট করতে হতে পারে। সারকথা, অর্থনীতিতে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে, জ্বালানি খাতে প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ মিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যরতে হয়। ঋণ পেতে দেরি হলে জ্বালানির এ ব্যয় হ্রাস করতে লোডশেডিং অনেক বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।