মোহাম্মদ ফয়সাল আলম: 

বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সপুষ্পক উদ্ভিদ, মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে। দেশের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলগুলোর অবস্থানগত কারণে জীববৈচিত্র্যময় সম্পদে ভরপুর। বাংলাদেশের বনাঞ্চলগুলোতে ৫,০০০ এর অধিক সপুষ্পক উদ্ভিদ প্রজাতি পাওয়া যায়।

এছাড়াও, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, উভচর প্রাণী এবং সরীসৃপ রয়েছে যা দেশের জৈবিক বৈচিত্র্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। দেশের পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতিও উল্লেখযোগ্য, যা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য ও সম্পদের পরিচয় বহন করে।

টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। হাওরটি তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’। প্রথমটি হলো সুন্দরবন। হাওরটি ৬ কুড়ি কান্দা এবং ৯ কুড়ি বিল নিয়ে গঠিত, যেখানে প্রচুর হিজল, করচ ও নলখাগড়ার বন রয়েছে। এখানে প্রচুর মাছ ও জলচর পাখি পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জকে ‘হাওরকন্যা’ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে এই হাওর।

https://dakdiyejai.news/

টাঙ্গুয়ার হাওরটি অতিথি পাখি, মাছ ও জীববৈচিত্র্যের কারণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে এই হাওরটি পরিযায়ী পাখি ও বন্যপ্রাণীর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হুমকির মুখে রয়েছে। স্থানীয় পাখি ও মাছ শিকারি এবং যত্রতত্র গাছ কাটার কারণে হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে এবং অতিথি পাখির সংখ্যা কমছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

১৯৯১ সালে ইরানের রামসার নগরে অনুষ্ঠিত বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সম্মেলনে গৃহীত রামসার কনভেনশন অনুযায়ী টাঙ্গুয়ার হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণার পর সরকারের সুনজর পড়ে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ মিঠা পানির এই হাওরের বিপুল সম্পদের দিকে। এর পর ২০০০ সালের ১০ জুলাই জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেসকো টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১০৩১তম রামসার সাইট ঘোষণা করে। ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসক ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) যৌথভাবে হাওরের দায়িত্ব নিলেও কোনো সুফল আনতে পারেনি। বরং টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্য ও সম্পদ ধ্বংস হয়েছে বলে জানান হাওরপাড়ের বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন:  বর্ষবরণে প্রস্তুত রমনার বটমূল

এই অবস্থার কারণ হিসেবে হাওরপাড়ের বাসিন্দারা উল্লেখ করেছেন, সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রচেষ্টার অভাব, স্থানীয় জনগণের সচেতনতার অভাব এবং অসাধু ব্যক্তিদের দ্বারা প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার এর মূল কারণ। টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং তার রামসার সাইটের মর্যাদা রক্ষা করা যায়।

https://dakdiyejai.news/

একসময় টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ, গাছ, পাখি এবং জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ ছিল। প্রতিবছর শীত শুরুর আগে থেকে সুদূর সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপালসহ শীতপ্রধান দেশ থেকে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসত টাঙ্গুয়ার হাওরসহ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে নিরাপদ আশ্রয় ও খাদ্যের আশায়। সেই সময় পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে উঠত হাওর। শীতকালে প্রচুর দেশি ও বিদেশি পর্যটক আসতেন পাখি দেখার জন্য। এখনো কিছু পর্যটক আসেন, কিন্তু আগের মতো আর নেই হাওরের জৌলুস, দিন দিন হারাচ্ছে।

হাওরের এই পরিবর্তনের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে, যার মধ্যে স্থানীয় অসাধু পাখি শিকারিদের কার্যক্রম, জলাভূমি এবং বনভূমির ক্ষয় এবং পর্যাপ্ত সংরক্ষণ উদ্যোগের অভাব অন্যতম। টাঙ্গুয়ার হাওরের হারানো জৌলুস পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন কার্যকরী সংরক্ষণ প্রচেষ্টা, স্থানীয় জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। এতে হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ হবে এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতি উন্নত হবে।

আরও পড়ুন:  যুদ্ধ বিরতির চূড়ান্ত পর্যায়ে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট-বড় ১২০টি বিল রয়েছে। ৪৬টি গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ২ লাখ ৮০ হাজার ২৩৬ হেক্টর জলাভূমি। প্রতি বছর এই হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। এছাড়াও এখানে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী বাস করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাঘা জানিয়েছেন, টাঙ্গুয়ার হাওর একটি গুরুত্বপূর্ণ রামসার সাইট, যা পরিযায়ী পাখি ও মাছের আভাসস্থল হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের অনেক দেশের মানুষ এই হাওরকে চেনে তার পরিযায়ী পাখির কারণে। তবে বর্তমানে আগের মতো আর পাখি আসে না, কারণ স্থানীয় সংঘবদ্ধ পাখি শিকারিদের কারণে হাওরের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং পরিযায়ী পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সংরক্ষণমূলক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।

https://dakdiyejai.news/

বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বিশ্ব ঐতিহ্য স্বীকৃত এই টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিযায়ী পাখিসহ বন্যপ্রাণী এখন হুমকিতে পড়েছে। অতিথি পাখি না এলে হাওরের তলদেশ শেওলায় ভরে যাবে এবং পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাবে। পাখির মল মাছের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে কাজ করে, যা না থাকলে মাছও পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে না। যেখানে প্রতি বছর শীতে লক্ষাধিক অতিথি পাখি আসত, সেখানে গতবছর মাত্র ২৫ হাজার অতিথি পাখি এসেছে।

আরও পড়ুন:  দেশের উদ্দেশে লন্ডন ছেড়েছেন খালেদা জিয়া

তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাখি শিকার বন্ধ করা, বনভূমি সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক হতে পারে। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং কার্যকরী সংরক্ষণ উদ্যোগের মাধ্যমে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার সম্ভব।

টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখি নিধন বন্ধ এবং বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে না পারলে এবং পাখি আসা ২০ হাজারের নিচে নেমে গেলে ইউনেস্কো টাঙ্গুয়ার নাম রামসার সাইট থেকে বাদ দিতে পারে। এতে টাঙ্গুয়ার নাম বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে মুছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই, টাঙ্গুয়ার হাওরে অসাধু পাখি শিকারিদের ছাড় দেওয়া হবে না এবং কঠোরভাবে দমন করা হবে। শুধু পাখিই নয়, হাওরের অন্য কোনো সম্পদও যাতে অসাধু চক্রের হাতে না পড়ে, সেজন্য প্রশাসন কঠোর ভূমিকা রাখছে।

পাখি নিধন বন্ধে সকলকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও তার রামসার সাইটের মর্যাদা রক্ষা করা সম্ভব হবে।

 

ডাক দিয়ে যাই // মোহাম্মদ ফয়সাল আলম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *