মোহাম্মদ ফয়সাল আলম:
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে যে ঋণের তৃতীয় কিস্তির বিষয়ে তাদের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতায় পৌঁছেছে। সংস্থাটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে অগ্রাধিকার দেয়ার পাশাপাশি ২০২৫ অর্থবছরের মধ্যে বাস্তব সম্মত কর নীতি প্রণয়ন করে রাজস্ব বাড়িয়ে কর-জিডিপি অনুপাত .৫ শতাংশ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।
আইএমএফ’র নির্বাহী বোর্ড অনুমোদন দিলে চলতি মাসের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ ঋণের পরবর্তী কিস্তিতে ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার আশা করছে। এর আগে ৪৭০ কোটি ডলারের মোট ঋণ চুক্তির অংশ হিসেবে দুই কিস্তিতে ১১৫ কোটি ৮২ লাখ ডলার ঋণ ছাড় করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি, বিনিময় হার নির্ধারণসহ কিছু সংস্কার এবং সুদ হার পূর্ণ উদারীকরণের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে আইএমএফ সমর্থিত সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।”
আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বাংলাদেশের অর্থ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে তৃতীয় কিস্তি ছাড়ার আশ্বাস দিয়েছে এবং কিছু সংশোধিত শর্তসহ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে যে, আইএমএফ সমর্থিত কর্মসূচির আওতায় কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, যার মধ্যে জ্বালানি খাতে মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থা অন্যতম। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা, পণ্য ও খাদ্যের আন্তর্জাতিক দাম বৃদ্ধি এবং কিছু অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত আছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, যা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।
এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিনিময় হারের বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া এবং ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালু করার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া, বাইরের বা মুদ্রাস্ফীতিজনিত চাপ বৃদ্ধি পেলে আরও শক্ত নীতি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছে।
আইএমএফ উল্লেখ করেছে যে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৪ শতাংশ হতে পারে এবং ২০২৫ অর্থবছরে এটি ৬.৬ শতাংশ হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯.৪ শতাংশ থাকবে তবে আগামী অর্থবছরে এটি কমে ৭.২ শতাংশ হতে পারে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
আইএমএফ বলেছে, ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি কমানো একটি অগ্রাধিকার। নন পারফর্মিং লোন কমিয়ে আনার কৌশল আর্থিক অগ্রগতিকে সহায়তা করবে যা দেশের অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক খাতের সক্ষমতা বাড়াতে নজরদারি অব্যাহত রাখতে হবে।
তারা আরও বলেছে যে, বাংলাদেশে কর ও জিডিপির অনুপাত খুবই কম এবং এটি বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক কল্যাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়াতে টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতেও অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। এজন্য আগামী বাজেটে বাস্তব কর নীতি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দিয়েছে তারা।
ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমানো এবং নন পারফর্মিং লোন হ্রাসের কৌশল: নন পারফর্মিং লোন (NPL) হ্রাস করার জন্য কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ। ব্যাংকগুলির আর্থিক স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কঠোর নজরদারি এবং নিয়মিত অডিট পরিচালনা। ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াগুলির উন্নতি করা। ঋণ পুনর্গঠন এবং পুনঃঅর্থায়ন প্রক্রিয়াগুলিকে সহজতর করা।
টেকসই রাজস্ব প্রবৃদ্ধি: কর আদায় ব্যবস্থার উন্নতি এবং কর ফাঁকি প্রতিরোধ। কর পদ্ধতি সরল করা এবং করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। নতুন কর নীতি এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ যা কর ভিত্তি প্রসারিত করবে। সামাজিক কল্যাণ এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে অধিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অর্জন করতে পারে।
আইএমএফ মনে করে যে ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নতির জন্য সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। এর পাশাপাশি বাণিজ্য বৈচিত্র্যকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। আইএমএফ-এর এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে এখনো পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয় বা সরকারের দিক থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি। আইএমএফ যখনই বাংলাদেশকে কোনো ঋণ দিয়েছে, তখনই তারা কিছু শর্ত বা পরামর্শ দিয়েছে। এসব শর্তের কিছু বাংলাদেশ মেনে নিয়েছে, আবার কিছু মেনে নেয়নি।
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে আইএমএফ-এর বেশ কয়েকটি শর্তের আলোকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (VAT) চালু করা হয়। এছাড়াও, বাণিজ্য উদারীকরণ এবং ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের শর্তও এসেছিল, যেগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকও জড়িত ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি।
আইএমএফ–এর সুপারিশের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো: রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা, নতুন বাজার অনুসন্ধান ও উন্নয়ন, বিনিয়োগের জন্য সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নীতিগত সুবিধা প্রদান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধি, বিনিয়োগকারী সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান, প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। এই সুপারিশগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হতে পারে।
এই ঋণ পাওয়ার জন্য আইএমএফ–এর শর্তসমূহ: ভর্তুকির প্রভাব কমিয়ে আনা ও বাজার ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ, বিনিময় হার নির্ধারণে বাজারের ভূমিকা বাড়ানো, কর ব্যবস্থা সহজতর করা ও সংবিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা, কর আদায় ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কর ফাঁকি প্রতিরোধ, ব্যাংকিং খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নন পারফর্মিং লোন কমানো, মূল্যস্ফীতির স্তর নিয়ন্ত্রণে আনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি আধুনিকায়ন ও কার্যকর করা, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাতে শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এই শর্তগুলো পূরণ করলে বাংলাদেশ আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আরও অগ্রগতি করতে সক্ষম হবে।
বাংলাদেশ ২০০৩ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ গ্রহণের পর বেশ কিছু বড় শর্ত পূরণের জন্য বাধ্য হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসান কমানো। সেই সময় আদমজী পাটকল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর ২০১২ সালে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয়।
সর্বশেষ, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দেয়। এই ঋণ মোট সাত কিস্তিতে প্রদান করা হবে এবং এর গড় সুদ হবে ২.২ শতাংশ।