মোহাম্মদ ফয়সাল আলম: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য অত্যন্ত গুরুতর, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের ভূগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
গ্রিনহাউজ গ্যাস যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), এবং নাইট্রাস অক্সাইড (N2O) অতিরিক্ত পরিমাণে নির্গমন হলে বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হয়ে উষ্ণায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এই কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশের মতো দেশের উপর এর প্রভাব অনেক বেশি দেখা যায়।
বন্যার প্রভাব: বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা বর্ষাকালে বন্যার কবলে পড়ে। এর ফলে দেশের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অবকাঠামোতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। ঘরবাড়ি, রাস্তা, এবং অন্যান্য অবকাঠামো বন্যার কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বন্যার কারণে বাস্তুচ্যুত হয় এবং তাদের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব: বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব বাংলাদেশের জন্য একটি সাধারণ বিষয়। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ও তীব্র বাতাসের কারণে উপকূলীয় এলাকা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জীবনহানি ঘটে এবং অনেক সম্পত্তি ধ্বংস হয়। ঘূর্ণিঝড়ের পর বন্যা দেখা দেয়, যা কৃষি ও অবকাঠামোর ওপর অতিরিক্ত প্রভাব ফেলে।
সমাধানের উপায়: গাছপালা রোপণ, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বন সৃষ্টি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব কমাতে সহায়ক। টেকসই কৃষি পদ্ধতির ব্যবহার, যেমন জলবায়ু সহনশীল ফসলের চাষ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে। উন্নত বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রবর্তন, যেমন বাঁধ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বন্যার ক্ষতি কমাতে পারে। স্থানীয় ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলি বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড়গুলির মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় গর্জনা এবং ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর উল্লেখযোগ্য, যা হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে এবং ব্যাপক সম্পত্তির ক্ষতি করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সৃষ্ট বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি জমি, ঘরবাড়ি, এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে।
উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব: ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে এবং ঘরবাড়ি ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে কৃষি জমি লবণাক্ত হয়ে যায়, যা ফসল উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রাস্তা, সেতু, এবং অন্যান্য অবকাঠামো ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ধ্বংস হয়ে যায়, যা দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে খরার প্রভাব: বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে খরা একটি নিয়মিত ঘটনা, যা কৃষিকাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। খরার কারণে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের হ্রাস ঘটে এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়। এর ফলে কৃষকদের ফসল উৎপাদন কমে যায় এবং তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে।
- খরার কারণে ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমে যায়, যা কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায়।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মাটি শুষ্ক হয়ে যায়, যা ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পানির প্রাপ্যতা কমিয়ে দেয়।
- ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ায় খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয় এবং খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
- কৃষিজ পণ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং দারিদ্র্য ও অভাবের হার বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু পরিবেশগতভাবে নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবেও বড় প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত পানি জমির অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে, যা কৃষি জমি, মাছ চাষের পুকুর, এবং পানীয় জলের উৎসকে লবণাক্ত করছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদন, মৎস্য সম্পদ এবং নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা হুমকির মুখে পড়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ত পানি জমির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এতে: লবণাক্ততার কারণে কৃষি জমির উর্বরতা কমে যায় এবং ফসল উৎপাদন কমে যায়। মাছ চাষের পুকুরে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়লে মৎস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানীয় জলের উৎস লবণাক্ত হয়ে পড়ে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি একটি বড় হুমকি। অনেক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের জীবিকা হারাচ্ছে এবং তাদের সামাজিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার ফলে একটি নতুন শ্রেণীর “জলবায়ু শরণার্থী” সৃষ্টি হচ্ছে, যারা অন্যত্র গিয়ে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবগুলো বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। তবে, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। দেশের সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রে কাজ করতে হবে যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাবগুলো মোকাবেলা করা যায়।