মোহাম্মদ ফয়সাল আলম : জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং সমস্যা। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে পরিচিত। এই পরিবর্তনের ফলে বায়ু ও জল দূষণ, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের (যেমন বন্যা ও খরা) সংখ্যাও বেড়েছে। এসব পরিবর্তনের প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষভাবে দৃশ্যমান, এবং বাংলাদেশ এর অন্যতম উদাহরণ।

বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং নদীর পানির স্তর বৃদ্ধির কারণে প্রায় প্রতি বছরই বড় বড় বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। শীতকালে পানির অভাব এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকা এবং দ্বীপগুলোতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে, যার ফলে কৃষি জমি এবং মিঠা পানির উৎস দূষিত হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলের জনজীবন এবং অবকাঠামোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবগুলো মোকাবিলা করার জন্য নীতি-নির্ধারক, স্থানীয় প্রশাসন, এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে জলবায়ু অর্থায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি: গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে অনেক প্রজাতি ও বাস্তুসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তবে এই শতাব্দীর শেষে তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি বাড়তে পারে।

    • বরফ গলে যাওয়ার ফলে মেরু ভাল্লুক এবং অন্যান্য প্রাণীরা তাদের বাসস্থান হারাচ্ছে।
    • অনেক প্রজাতি উষ্ণতা সহ্য করতে না পেরে বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে।
    • তাপপ্রবাহের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, যেমন হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা।
    • শহরাঞ্চলে তাপদ্বীপ প্রভাবের কারণে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
    • সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং তাপমাত্রা পরিবর্তনের কারণে অনেক প্রজাতির প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
    • কোরাল রীফগুলো উষ্ণতা এবং অম্লীকরণ সহ্য করতে না পেরে মারা যাচ্ছে, যা সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আরও পড়ুন:  মসজিদে মসজিদে শবেকদরের নামাজ

https://dakdiyejai.news/

প্রাকৃতিক দুর্যোগ: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। এতে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, এবং দাবানলের মতো দুর্যোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হচ্ছে।

    • বৃষ্টিপাতের ধরণে পরিবর্তনের কারণে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে।
    • বিশেষ করে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে বর্ষাকালে বন্যার প্রকোপ অনেক বেড়েছে।
    • এর ফলে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং কৃষিজমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
    • পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খরার তীব্রতা ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
    • আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে খরার কারণে ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
    • বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা এবং শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
    • বিশেষ করে ক্রান্তীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক ক্ষতি করছে।
    • উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।
    • তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে দাবানলের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
    • ক্যালিফোর্নিয়া, অস্ট্রেলিয়া, এবং দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে দাবানল ব্যাপক ক্ষতি করছে, বনভূমি ধ্বংস করছে, এবং বায়ু দূষণ বাড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন:  সন্দ্বীপ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অনন্য উদাহরণ

বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় শক্তিশালী বাঁধ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এবং সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করা। খরার প্রভাব কমাতে পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা। দাবানল প্রতিরোধের জন্য বনায়ন ও পুনঃবনায়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি: সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম গুরুতর প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি এবং এটি উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে আর্কটিক এবং আন্টার্কটিক অঞ্চলের বরফ এবং হিমবাহ দ্রুত হারে গলছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।

    • গ্রীনল্যান্ড এবং পশ্চিম আন্টার্কটিকার বরফের ধ্বংস প্রক্রিয়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
    • গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলে গেলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
    • সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানির আয়তন বাড়ছে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ।
    • তাপীয় সম্প্রসারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে প্রায় অর্ধেক অবদান রাখে।
    • মালদ্বীপ এবং কিরিবাতি মতো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তাদের ভূমি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।
    • উপকূলীয় শহরগুলোতে বন্যা এবং লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষি ও পানীয় জল সরবরাহকে হুমকির মুখে ফেলছে।
    • বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ডস, এবং ভিয়েতনামসহ অন্যান্য উপকূলীয় দেশগুলোতেও এর প্রভাব স্পষ্ট।
আরও পড়ুন:  তাপপ্রবাহের তীব্রতা আরও বেড়েছে, সৃষ্টি হতে পারে লঘুচাপ

প্রভাব চ্যালেঞ্জসমূহ: উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের বাস্তুচ্যুত হতে হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জন্য জীবিকা ও জীবনের জন্য হুমকি। লবণাক্ত পানি কৃষিজমি এবং মিঠা পানির উৎস দূষিত করছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। উপকূলীয় বাস্তুসংস্থান এবং জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে। ম্যানগ্রোভ বন এবং অন্যান্য উপকূলীয় পরিবেশ ধ্বংসের পথে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কেবলমাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। তাই, এ সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাপী সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *